২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার,ভোর ৫:২০

জলবায়ু পরিবর্তনে নতুন মানচিত্র আঁকছে ‘বাংলাদেশ’

প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২৫

  • শেয়ার করুন

সাকিবুল ইসলাম : বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এটি বাংলাদেশের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের গভীর হুমকি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূল ধ্বংস ও জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতির ফলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশকে তার মানচিত্র নতুনভাবে আঁকতে হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশর ২১টি উপকূলীয় জেলা ডুবে যেতে পারে, কোটি মানুষ গৃহহীন হবে এবং কৃষি ও মাছ চাষে ব্যবহৃত নদীগুলোয় লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তন মানে শুধু মিঠা পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়া নয়, আমাদের ভূখণ্ড হারানো, জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এবং সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়া।
তথ্যমতে, ২১০০ সালের মধ্যে মালদ্বীপের মতো ৫২টি ছোট দ্বীপরাষ্ট্র সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের অবস্থা আরো সংকটাপন্ন। দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ প্রোটিনের জন্য মিঠা পানির মাছের ওপর নির্ভরশীল। লবণাক্ততা এই জীবনরেখা ধ্বংস করে দিতে পারে। দেশে প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার কারণে জিডিপির ২ শতাংশ ক্ষতি হারাচ্ছে। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার দ্বিগুণ হতে পারে। ফসলহানি, পানির সংকট ও গণবাস্তুচ্যুতি সংঘাত সৃষ্টি করবে।

এ প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চ কেন্দ্রের গবেষক ড. এহতেশামুল কবির এ প্রতিবেদককে জানান, বিশ্বব্যাপী জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতি হচ্ছে মানুষেরই ভুলের কারণে। এটি আসলে প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা নয়। এ জন্য বাস্তুচ্যুতদের অধিকার আদায়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর কাছে জোর দাবি জানাতে হবে আন্তর্জাতিক ফোরামে। এখনই জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতদের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ প্রটোকল থাকা উচিত।

তথ্য মতে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে জি-২০ ভুক্ত দেশগুলো। অথচ, বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁঁকিতে সপ্তম অবস্থানে থাকা একটি দেশ এবং সবচেয়ে বেশি ভুগছে। এর আগে, ২০২৪ সাল ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। সমুদ্রের উষ্ণতা ও হিমবাহ গলে যাওয়ার হার দ্বিগুণ হয়েছে। বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা আমাদের মতো দেশের জন্য মৃত্যুদণ্ড। সব দেশ তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেও তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়বে; যা মানবজাতির জন্য সহনশীল মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।

আবহমানকাল থেকে এ বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য বর্তমান ছিল। ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্য আলাদাভাবে এ দেশে উপলব্ধ হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তÑ এই ছয় ঋতুর কারণে দেশটিকে ষড়ঋতুর দেশও বলা হয়ে থাকে। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত হালকা শীত অনুভূত হয়। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল চলে। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকে। তাই জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে বর্ষা মৌসুম। এ সময় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়; যা অনেক সময়ই বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। এছাড়া মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের আগমুহূর্তে কিংবা বিদায়ের পর পরই স্থলভাগে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো কিংবা সাগরে নিম্নচাপ, জল-ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়। এর আঘাতে বাংলাদেশ প্রায় নিয়মিতই আক্রান্ত হয়। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে এখন দেশের ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্যই পাল্টে যাচ্ছে।

বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা গেছে, ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার উঁচু হতে পারে। ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮ দশমিক ৩ অংশ নিমজ্জিত হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্র মতে, রাজশাহীর উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯১ সালে পানির স্তর ছিল ৪৮ ফুট। ২০০০ সালে তা নেমে ৬২ ফুট এবং ২০০৭ সালে নেমে যায় ৯৩ দশমিক ৩৪ ফুটে। স্বাভাবিক বন্যায় দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। বর্তমানে বন্যার সংখ্যা ও তীব্রতাÑ দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে খুব দ্রুত ও ব্যাপক পদক্ষেপ না নিলে আগামী দশকের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, শিল্প-বিপ্লব সময়ে আগের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছড়িয়ে যাবে। যত ২১০০ সাল নাগাদ ৩ দশমিক ৩ থেকে ৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে দিন দিন আবহাওয়া আরও বিপজ্জনক আচরণ করবে, সামুদ্রিক ঝড় বেশি হবে এবং জলোচ্ছ্বাস বাড়বে। জার্মানির রুহর বিশ্ববিদ্যালয় বোখাম ও একটি জার্মান বেসরকারি মানবিক সংস্থা ডেভেলপমেন্ট হেল্প অ্যালায়েন্সের যৌথভাবে করা একটি গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি করে বলছেন, এভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল পানির নিচে চলে যাবে। সৃষ্টি হতে পারে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। তাছাড়া বিশ্বের উষ্ণতা যতই বাড়ছে, হিমালয় ততই গলছে। অতিরিক্ত উষ্ণতার কারণে ঋতুতেও হেরফের দেখা দিচ্ছে। অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা হানা দিচ্ছে; সাগরে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন ঘূর্ণিঝড়। তা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে সক্ষম। আদিকাল থেকে বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাফল্য লাভ করেছে। খেয় করলেই দেখা যাবে, অতীতের তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে এসেছে। কিন্তু সমুদ্রের লবণাক্ততা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ব্যাপকভাবে খাদ্য ও বাসস্থান সংকটে পড়তে হবে আমাদের। গত ২০ বছরে জেলা সাতক্ষীরার মাটিতে লবণ অনেক বেড়েছে। এ জন্য চাষাবাদের অযোগ্য হয়েছে অনেক জমি। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলায় আমাদের আরও সোচ্চার হওয়া জরুরি। লবণাক্ত পানিতে চাষাবাদের যোগ্য ধান আবিষ্কার হলেও তা বেশিদিন চাষ করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই।

এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অর্থায়ন সংক্রান্ত গবেষক শারমিন্দ নীলর্মী এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবির্তনের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক উৎস থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ খুবই কম। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার মিলেছে। এই অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতির আকৃতি বিবেচনায় নিলে তেমন কিছুই নয়। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে সরকার নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।’ এছাড়া আরও কয়েকটি উৎস থেকে ১২০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা এসেছে বাংলাদেশে বলে জানান তিনি।

  • শেয়ার করুন