২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার,রাত ১২:১৯

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর প্রভাব

প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২৫

  • শেয়ার করুন

মো. শামসুল ইসলাম : জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী অন্যতম একটি আলোচিত বিষয়। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনের জন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ি করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানিরা। এর পরেই রয়েছে- রাশিয়া, ভারত, জার্মানি, ব্রাজিল ও অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশ। অন্যদিকে, জনসংখ্যার হিসেবে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করছে অস্ট্রেলিয়া।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে কার্বন নির্গমনের হার একেবারেই কম, শতকরা প্রায় শূন্য দশমিক দুই ভাগ মাত্র। মূলত, উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে দায়ী। অথচ, জলবায়ুর এ পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে আগেই। এতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখনই কমানো না গেলে খুব দ্রুতই বিশ্বকে মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। বাংলাদেশে দুই দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুস্পষ্ট।

ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ সব সময়ই দুর্যোগপ্রবণ দেশ, এর পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দুর্যোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে তীব্র তাপদাহ, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা, নদীভাঙন কিংবা বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এখানে বন্যা, আকস্মিক বন্যা, ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, লবণাক্ততা ইত্যাদির মাত্রা বেড়ে যাবে। দেশের উত্তরাঞ্চলে খরা ও মরু প্রবণতা দেখা দেবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ঝড় ও সাইক্লোনের প্রকোপ বাড়বে।

সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হলে বাংলাদেশের নদী-মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের ওপর নেমে আসবে বিপর্যয়। শত শত বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চল অধিক মাত্রায় প্লাবিত হবে। বন্যার ব্যাপকতায় মানুষের জীবনধারণ, কৃষি, গবাদিপশু, দালানকোঠা ও ভৌত কাঠামো ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হবে। এর প্রমাণ বিগত বছরগুলোর ভয়াবহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও খরা। সিলেট অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যাও এর আরেকটি প্রমাণ।

উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাসহ বিভিন্ন এলাকা আকস্মিকভাবে বন্যাকবলিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানি সংকট তৈরি হয়। যে কারণে বিভিন্ন অঞ্চল মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি উজানের পানির ঢলে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে। আইপিসিসির সর্বশেষ গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমান সময়ের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বর্ষাকালে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির তুলনায় শীতকালে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার হবে বেশি। শীতের তীব্রতা অনেকটাই কমে যাবে; কিন্তু গ্রীষ্মকালে গরমের মাত্রা ক্রমেই বাড়বে। এতে দেশে ছয়টি ঋতুর পরিবর্তে শুধু চারটি ঋতু আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাবে।

বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন। ১ কোটি মানুষ এরই মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর ৪ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন। এদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন (ক্লাইমেট চেঞ্জ রিলেটেড মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশ) শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৯৬ লাখ অভিবাসী তৈরি হবে। উষ্ণতা বাড়লে ঘূর্ণিঝড় বাড়বে। ফলে বাসস্থান, জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।

বৃষ্টিপাতের ধারা পরিবর্তন হয়ে খরা বেড়ে যাবে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত পানি বেড়ে যাবে এবং ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে। যার আলামত এরই মধ্যে আমরা পেতে শুরু করছি।

জাতিসংঘের এক হিসাবে, যদি জলবায়ুর উষ্ণতা এই গতিতে বাড়তে থাকে, তাহলে সমুদ্র ও নদীর স্তর বৃদ্ধির ফলে কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হবে।

নেতিবাচক প্রভাা পড়বে ভারত এবং বাংলাদেশে। উপরন্তু ভারত-বাংলাদেশের মতো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর জন্য বিপদ আরো বেশি। উষ্ণতার এ হার অব্যাহত থাকলে, মোট স্থলভাগের অনেক এলাকার ভূমি বিলীন হবে।

এছাড়া, জমির উর্বরতা হ্রাস পাবে। ফলে উৎপাদন কমে যাবে। অন্যদিকে রয়েছে অধিক জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ। সম্পদের সংকট আর জনসংখ্যার আধিক্য মিলে দেখা দেবে এক অপরিহার্য দুর্ভোগ। এসবের ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমছে, বাড়ছে নিত্যনতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অসুখ-বিসুখ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা। শহরাঞ্চলে বস্তিবাসীর সংখ্যাও বাড়ছে। মানবজাতি উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও এ অবস্থা মানুষেরই সৃষ্টি।

বর্তমানে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারসাম্য রক্ষা করতে না পরলে এ সমস্যাই যে বর্তমান সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। বাঁচাতে হবে বিপন্ন হওয়ার পথে এ পৃথিবীকে। আসুন, আমরা সবাই মিলে সুন্দর এ পৃথিবীটাকে রক্ষা করি এবং বাসযোগ্য করে তুলি।

  • শেয়ার করুন