প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২৫
মো: মহিন উদ্দীন : বিশ্ব এখন এমন এক বিপন্ন সময়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে প্রকৃতির ভারসাম্য ভেঙে পড়ার লক্ষণ প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হচ্ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, খরা, নদীভাঙন, হিমবাহ গলন কিংবা সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি-এসব এখন আর কাল্পনিক আশঙ্কা নয়, বরং বাস্তব ও যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা। জলবায়ু পরিবর্তনের এই দুর্যোগ সবার জন্য হুমকি হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলো, যাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের বিশেষ ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য যেমন বদ্বীপভূমি, ঘনবসতি, নদীমাতৃক অঞ্চল এবং দীর্ঘ উপকূলীয় সীমান্ত-সব মিলিয়ে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী জলবায়ুজনিত দুর্যোগের সম্মুখীন। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিচ্ছে, এবং ঘন ঘন বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড় বহু মানুষকে গৃহহীন করে তুলছে। প্রতিনিয়ত বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষজনের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবিকাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে।
বৈশ্বিক সম্মেলন কপ ৩০: একটি মোড় ঘোরানো সম্ভাবনা
২০২৫ সালে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে বসতে যাচ্ছে জলবায়ুবিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনের ৩০তম আসর। এ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক অঞ্চল আমাজন বনাঞ্চলের কাছাকাছি। প্রতীকী অর্থে এই স্থান নির্বাচনের তাৎপর্য অনেক। পৃথিবীর ‘ফুসফুস’খ্যাত এই অরণ্য শুধু গাছের নয়, বরং মানব সভ্যতারও টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।
এই সম্মেলন বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে এক সুস্পষ্ট বার্তা দেবে-প্রকৃতির সুরক্ষাকে শুধু আলোচনার বিষয় না রেখে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রেই পরিণত করতে হবে।
আলোচনার অগ্রাধিকার
১. ক্ষতিপূরণ তহবিল প্রতিষ্ঠা – যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে কম ভূমিকা রেখেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর সহায়তা তহবিল গঠনের দাবিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
২. জ্বালানি ব্যবস্থার রূপান্তর – জীবাশ্মভিত্তিক শক্তি ব্যবস্থার বদলে সুর্যশক্তি, বায়ুশক্তি এবং জলবিদ্যুৎ-ভিত্তিক শক্তির দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।
৩. আর্থিক সহায়তার জবাবদিহিতা – উন্নত দেশগুলো বারবার আর্থিক প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাস্তবে তার অনেকটাই অপূর্ণ। সেই প্রতিশ্রুত অর্থ বাস্তবায়নের কঠোর মূল্যায়ন কাঠামো চাই।
৪. ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অধিকার রক্ষা – যারা জলবায়ু দুর্যোগে সরাসরি আক্রান্ত, তাদের জন্য বিশেষ কৌশল ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ অপরিহার্য।
বাংলাদেশের প্রত্যাশা
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন নীতিমালা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। যেমন: দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন পরিকল্পনা, দুর্যোগ সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু তহবিল গঠন ইত্যাদি। তবে সীমিত সম্পদ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এসব উদ্যোগ টেকসই করা কঠিন।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কপ ৩০ সম্মেলনে যেসব বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন:
জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা সহজ শর্তে নিশ্চিত করা
জলবায়ুজনিত অভিবাসীদের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সুরক্ষা
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের পূনর্বাসনে সহায়তা
উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তি সহায়তা বাস্তবায়ন
বৈষম্যের অবসান ও নৈতিক দায়িত্ব
এটা স্পষ্ট যে, যারা পরিবেশ দূষণে প্রধান ভূমিকা রেখেছে, তারা খুব কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ যারা দায়ী নয়, তারা আজ জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত। এই বৈষম্য শুধরে দেওয়া এখন একটি বৈশ্বিক নৈতিক দায়িত্ব।
কপ ৩০ যেন শুধু বক্তৃতা বা নথিপত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে কার্যকর সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা করে-সেটাই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।
একবিংশ শতাব্দীর এই চরম বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই কোনো বিকল্প নয়। এটি টিকে থাকার সংগ্রাম। কপ ৩০ হবে কি না কার্যকর পদক্ষেপের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত, তা নির্ভর করছে বিশ্ব নেতৃত্বের ইচ্ছাশক্তির ওপর।
বাংলাদেশসহ প্রত্যেক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের কণ্ঠস্বর যেন শুধু প্রতিনিধিত্ব নয়, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে-এই দাবি এখন সময়েরই দাবি।
“প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে উন্নয়ন নয়, প্রকৃতিকে সঙ্গী করেই নির্মাণ হোক আগামী পৃথিবী।”