২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার,রাত ২:৪৬

পরিবর্তনশীল জলবায়ুতে ভঙ্গুর হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি

প্রকাশিত: এপ্রিল ২১, ২০২৫

  • শেয়ার করুন

সাকিবুল ইসলাম : বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব শুধু পরিবেশগত নয়; একটি দেশের অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। যা দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য ব্যাপক হুমকিস্বরূপ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী শত্রু তথা জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে চলেছে। কৃষিতে ফলন হ্রাস থেকে শুরু করে দেশের অবকাঠামোগত সমৃদ্ধিতে পরিবর্তনশীল জলবায়ুর কঠোর বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এ দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো হরহামেশা লেগেই রয়েছে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) অনুমান করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে জিডিপিতে বার্ষিক ২ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে; যেখানে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশেরও বেশি। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রায় ১০০ কোটির মতো অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বলা হয় কৃষি খাতকে। জলবায়ু পরিবর্তনশীলতার ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই খাতে জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ হারিয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে, চালের উৎপাদন ১ দশমিক শূন্য ২৮ শতাংশ ও গবাদিপশু থেকে আয় শূন্য দশমিক ১৭৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য পণ্য উৎপাদন সূচকের অবস্থা আরও শোচনীয় পর্যায়ে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

দেশে রেকর্ডভাঙা তাপদাহ, ভয়াবহ বন্যা আর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনকে করুণ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে যে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে, আগামী ২৬ বছরে ওই অর্থ আয়ই ১৯ শতাংশ কমে যাবে বিশ্বে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ ১৯ লাখ কোটি থেকে ৫৯ লাখ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হবে বিশ্ব।

এ প্রসঙ্গে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় থাকা দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার দিক থেকে বাংলাদেশের হয়তো খুব বেশি কিছু করার নেই। কারণ, সমস্যাটা তো বৈশ্বিক। সেটির সমাধানের জন্য উন্নত দেশগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে দুর্যোগ বেশি হচ্ছে; নদী ভাঙন বাড়ছে; বেশি বেশি ঝড়, বন্যা হচ্ছে। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গে শুষ্কতা তৈরি হচ্ছে আর দক্ষিণবঙ্গে লবণাক্ততা বাড়ছে। এসব কিছুই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি যে হারে বাড়ছে। এতে ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতিই ভবিষ্যতে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নয়; বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতিও গভীর সংকটের মুখে পড়বে।

ইউরোপিয়ান ইকোনমিক ফোরামের মতে, আগামী দিনগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হারাবে। সম্প্রতি, বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণায় এই আশঙ্কার কথাই বলা হচ্ছে। আগামী কয়েক দশকে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।

গবেষণা বলছে, বিশ্বের ১৮৪টি দেশের মানুষ ও অর্থনীতির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ডিআরএর এক প্রতিবেদনে অনেক আগেই বলা হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধি কমবে জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বের আনুমানিক ৮০ লাখ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে।

তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষি খাত বড় সংকটের মুখোমুখি। দেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর এবং ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান এই খাত থেকে আসে। তবে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে; বিশেষ করে ধান। যা দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ও কৃষির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের কারণেও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, ভূ-পৃষ্ঠের মাটির কার্বন শোষণ ক্ষমতা যেমন অনেক, তেমনি জীববৈচিত্র্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক বটে। বিভিন্ন অণুজীব, প্রাণী, উদ্ভিদের আবাসস্থল ভূমি। মানুষ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ নষ্ট করছে; ধ্বংস করছে জীবের জন্ম ও বৃদ্ধিসহ বসবাসের পরিবেশ। এছাড়াও জলবায়ুর পরিবর্তনে অতি খরার কারণে মাটির ক্ষয় এবং রাসায়নিক দূষণে মাটির কার্বন শোষণ হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণে মাটি তার মূল অনুষঙ্গ হারিয়ে দিন দিন অনুর্বর হয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার বিস্তার, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় এবং দূষণ এভাবে চলতে থাকলে পুরো বিশ্ব অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হবে। ধরিত্রী এবং এখানকার বসবাসকারীদের স্বার্থে সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য যেসব জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে; সেগুলো সর্ব-সম্মতভাবে কার্যকর করা এখন অতি জরুরি হয়ে পড়ছে।

জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বোরো ধানের উৎপাদন ১৭ শতাংশ এবং গম উৎপাদন ৩২ শতাংশ কমে যেতে পারে। পেঁয়াজ, রসুন, আলু এবং অন্যান্য অর্থকরী ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর পাশাপাশি মাটির গুণগত মান নষ্ট হওয়ার কারণে কৃষিকাজের খরচ বাড়ছে। তাছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পোকামাকড় ও রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়বে; যা কৃষকের জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাপমাত্রার পাশাপাশি বর্ষার অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও শুকনো মৌসুমে খরার ফলে সেচব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়বে এবং কৃষি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। রাতের উচ্চ তাপমাত্রা ধানের ফলন কমিয়ে দেয়Ñ এটি একটি গুরুতর সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায়, বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান মিলন এ প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। ছোট আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ, জনসংখ্যার চাপ ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কারণে এ সংকটের প্রভাব বেড়েই চলছে। ফলে, জলবায়ুর এ বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন অভিযোজন কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে। যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা যায়। বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ব্যাপক হারে কমাতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।

  • শেয়ার করুন